যাকাত: সম্পদের পবিত্রতা, আত্মার শুদ্ধতা
ভূমিকা
যাকাত — এই শব্দটি উচ্চারণে রয়েছে আর্থিক দায়িত্ববোধের সৌন্দর্য, মানবিকতার পরিচ্ছন্ন প্রতিচ্ছবি, আর দয়ার এক আশীর্বাদময় দিকচিহ্ন। এটি কেবল দানের কোনো প্রথা নয়; এটি একটি ফরজ ইবাদত, ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। যে যেমন উপার্জন করে, তার এক নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র, অসহায় ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের হক। আর এই হক আদায় করাই হচ্ছে যাকাত।
যাকাতের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
"যাকাত" শব্দটি এসেছে আরবি "زكاة" শব্দ থেকে, যার অর্থ — পবিত্রতা, বৃদ্ধি, পরিশুদ্ধি। অর্থাৎ, যাকাত দ্বারা মানুষ তার সম্পদকে যেমন পবিত্র করে, তেমনি নিজের আত্মাকে করে উন্নত।
আল্লাহ বলেন:
“তুমি তাদের মাল থেকে সদকা গ্রহণ করো, যার দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করো এবং পরিশুদ্ধ করো।”
— (সূরা তাওবা, আয়াত ১০৩)
যাকাত ফরজ হওয়ার ইতিহাস
হিজরতের দ্বিতীয় বছরে, রমজান মাসে যাকাত ফরজ করা হয়। এর আগে মুসলমানরা সাধারণ সদকা দিতেন, তবে সেটি ছিল ঐচ্ছিক। আল্লাহ তায়ালা যখন মদিনায় একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি সমাজ গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন করলেন, তখনই যাকাতকে বাধ্যতামূলক করে দেন — যাতে ধনী ও গরিবের মাঝে দয়া ও সাম্যের এক সেতুবন্ধন তৈরি হয়।
যাকাত কাদের ওপর ফরজ?
যাকাত সেই মুসলমান ব্যক্তির ওপর ফরজ যিনি—
-
বালেগ ও প্রাপ্তবয়স্ক,
-
আক্ল বা জ্ঞানসম্পন্ন,
-
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক (সোনা বা রুপার পরিমাণ),
-
এবং ঋণমুক্ত।
যার কাছে এক হিজরি বছর ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ জমা থাকে, তাকেই সেই সম্পদের উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হয়।
যাকাতের হিসাব ও পরিমাণ
-
সোনার নিসাব: প্রায় ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম)
-
রূপার নিসাব: প্রায় ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম)
যার কাছে এত পরিমাণ সোনা বা রূপার সমমূল্যের নগদ অর্থ বা মাল-মসলা থাকে, তিনি যাকাত দিতে বাধ্য। হারে: ২.৫% প্রতি বছর।
উদাহরণ:
আপনার কাছে ১ লাখ টাকা এক বছর ধরে রয়েছে → যাকাত হবে ২,৫০০ টাকা।
যাকাত কাদেরকে দেওয়া যাবে?
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আট শ্রেণির মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদেরকে যাকাত দেওয়া বৈধ:
-
গরিব
-
মিসকিন (অতি দরিদ্র)
-
যাকাত আদায়ের কর্মী
-
ইসলামে আকৃষ্ট নতুন মুসলিম
-
দাসমুক্তির জন্য
-
ঋণগ্রস্ত
-
আল্লাহর পথে (জিহাদ/দাওয়াহ)
-
মুসাফির
সূরা তাওবা, আয়াত ৬০ এ এই শ্রেণিবিন্যাস বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে।
যাকাতের মূল উদ্দেশ্য
-
ধনীদের সম্পদে গরিবের হক নির্ধারণ করা
-
সমাজে আর্থিক ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা
-
গরিবের প্রতি সহমর্মিতা জাগানো
-
ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি
-
সম্পদের অহংকার দূর করা
-
আত্মাকে অহমিকা ও কৃপণতা থেকে মুক্ত রাখা
হাদিসে যাকাতের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ বিষধর সাপের রূপে তার গলায় জড়িয়ে পড়বে।”
— (সহীহ বুখারি)
আরও বলেন:
“যাকাত সম্পদকে হ্রাস করে না।”
— (তিরমিজি)
যার অর্থ—অন্তরে ভয় থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে দান করা হয়, আল্লাহ সেই দানে বরকত বাড়িয়ে দেন।
কৃষি, পশু ও ব্যবসার যাকাত
ইসলামে শুধু নগদ অর্থ বা গহনার যাকাতই নয়, কৃষিজ ফসল, গবাদি পশু ও ব্যবসার মালামাল থেকেও যাকাত দিতে হয়। প্রতিটির আলাদা নিয়ম আছে, যা ইসলামিক স্কলার বা মুফতির কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে হিসাব করা উত্তম।
যাকাতের সামাজিক উপকারিতা
-
সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি হ্রাস পায়
-
চাকরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়
-
শান্তি ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়
-
বিত্তবানদের অহংকার ভাঙে
-
গরিবদের জীবনে আশার আলো জাগে
যাকাত আত্মারও পরিশুদ্ধি
যাকাত শুধু সম্পদের পবিত্রতা নয় — এটি আত্মার এক প্রশান্তি। কৃপণতা, হিংসা, অহংকারের মতো মানসিক রোগ থেকে মুক্তি দেয়। একজন ধনী যখন যাকাত দেয়, সে নিজের ভেতরেই এক প্রশান্তি অনুভব করে—সে জানে, তার উপার্জন শুধু তার একার জন্য নয়, বরং আল্লাহর জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য।
যাকাত না দিলে কী হয়?
যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির হুমকি।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে আর আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
— (সূরা তাওবা: ৩৪)
যাকাতুল ফিতর (ফিতরা)
রমজানের শেষে ঈদের পূর্বে যাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। এটি মূলত সবার পক্ষে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার একটি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে দরিদ্ররাও ঈদের দিনে খাদ্য ও পোশাক পায়।
যাকাত একটি আলোর পথ
যাকাত কোনো কর নয়, এটি ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। এটি একজন মুসলমানের ভেতরকার মানবিকতা, দায়িত্ববোধ এবং পরোপকারের ইবাদত। যখন ধনী নিজের অর্থের হক গরিবের হাতে তুলে দেয়, তখন সমাজে ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং ঐক্য গড়ে ওঠে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে যাকাতের গুরুত্ব বুঝে যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।