রোজা

 রোজা বা সাওম (আরবি: صوم) হলো ইসলামে অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত। “সাওম” শব্দের অর্থ হলো বিরত থাকা, যার মধ্যে বিশেষভাবে খাদ্য, পানীয়, যৌন আচরণ ও অপবিত্র কাজ থেকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকা বোঝানো হয়।

এটি ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। মুসলিমদের জন্য রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর—যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।”
— [সূরা বাকারা: ১৮৩]

রোজার ধারণা শুধুমাত্র ইসলামে নয়, বরং পূর্ববর্তী ধর্ম ও জাতিগুলোর মধ্যেও বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, রোজা পূর্ববর্তী উম্মতের উপরও ছিল। যেমন:

  • ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বিভিন্ন উপলক্ষে উপবাস করত।

  • হযরত মূসা (আ.) সিনাই পর্বতে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার পূর্বে চল্লিশ দিন উপবাস করেছিলেন (বাইবেল, Exodus 34:28)।

  • হযরত ঈসা (আ.) চল্লিশ দিন উপবাস করেছিলেন (ম্যাথিউ 4:2)।

তবে ইসলামে রোজা পেলেছে পরিপূর্ণ রূপ, একটি নির্দিষ্ট মাস ও একটি নির্দিষ্ট সময়ের ধারা অনুযায়ী।

ইসলামে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার ঘটনা

১ম হিজরিতে ইসলামী ক্যালেন্ডার শুরু হয়।

২য় হিজরির শাবান মাসে রোজা ফরজ হয়।

এ সময় মদীনায় মুসলিম উম্মাহ একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোতে উপনীত হয়। তাফসিরকারগণ উল্লেখ করেন, রমজান মাসে রোজা ফরজ করা হয়েছে ২য় হিজরির শাবান মাসে, অর্থাৎ হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর।

রোজার সময়সীমা:

  • শুরু: সুবহে সাদিক (ফজরের সময়)

  • শেষ: সূর্যাস্ত (মাগরিবের সময়)

যেসব কাজ রোজা ভঙ্গ করে:

  1. ইচ্ছাকৃতভাবে খাওয়া-দাওয়া

  2. পান করা

  3. স্ত্রী সহবাস

  4. ইচ্ছাকৃত বমি

  5. ঋতুবতী বা নেফাস অবস্থায় থাকা

হাদিসে রোজার গুরুত্ব

রাসূল (সা.) বলেন:

"রোজা ঢালস্বরূপ।"
— [বুখারি, মুসলিম]

"যে ব্যক্তি রমজানের রোজা ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় রাখে, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।"
— [সহীহ বুখারি, হাদিস ৩৮]

"জান্নাতে রায়্যান নামে একটি দরজা আছে, কিয়ামতের দিন কেবল রোজাদাররা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।"
— [সহীহ বুখারি]

রোজার আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উপকারিতা

✦ আত্মশুদ্ধি:

রোজার মাধ্যমে আত্মা শুদ্ধ হয়, খারাপ অভ্যাস দূর হয়, আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়।

✦ ধৈর্য ও আত্মসংযম:

রোজা মানুষকে ধৈর্যশীল হতে শেখায়।

✦ সামাজিক সমতা:

রোজার মাধ্যমে ধনী-গরীব সকলেই অনাহারের কষ্ট অনুভব করে, ফলে সহানুভূতি সৃষ্টি হয়।

✦ শারীরিক উপকারিতা:

  • হজম শক্তি বৃদ্ধি

  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ

  • কোলেস্টেরল হ্রাস

  • বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ

রোজার বৈশ্বিক প্রভাব

প্রতি বছর দুনিয়ার প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মুসলমান একযোগে রোজা রাখে। এটি এক অনন্য ঐক্য ও সংযমের বহিঃপ্রকাশ।

বিশ্বের অনেক অমুসলিম দেশেও এখন রোজার স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে গবেষণা করা হয়। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নামক আধুনিক খাদ্যচর্চাও রোজা থেকে অনুপ্রাণিত।

রোজার শিক্ষণীয় বিষয়

  1. তাকওয়া অর্জন: আল্লাহভীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন।

  2. অহংকার ভাঙা: ক্ষুধা ও তৃষ্ণা আমাদের দীনতার স্মরণ করায়।

  3. সমবেদনা: গরীবের প্রতি সহানুভূতি জন্মে।

  4. ঐক্য: একটি নির্দিষ্ট মাসে একই কাজ করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য গড়ে ওঠে।

রোজা ছাড়া যেসব রোজা রয়েছে

  1. নফল রোজা: যেমন আরাফার দিন, আশুরার দিন, সোম ও বৃহস্পতিবার।

  2. কাফফারার রোজা: শপথ বা রোজা ভঙ্গের কাফফারা স্বরূপ।

  3. নজর রোজা: মানত করলে পালন করতে হয়।

রমজানের রোজা শুধু একটি ধর্মীয় ফরজ নয়, এটি মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ:

  • ইফতার মাহফিল

  • তারাবিহ নামাজ

  • কুরআন খতম

  • জাকাত ও সদকা

  • ঈদের প্রস্তুতি

রোজা বা সাওম মুসলমানদের জীবনে একটি বহুমাত্রিক ইবাদত — যা আত্মা, মন ও শরীরকে বিশুদ্ধ করে। এটি তাকওয়া অর্জনের পথ, গুনাহ মোচনের উপায় এবং আখিরাতে মুক্তির মাধ্যম। এর সূচনা ইতিহাসে বহু পূর্ব থেকেই থাকলেও, ইসলামে এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে। রোজা মুসলিম উম্মাহর সংহতি ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক।

Post a Comment